মুহাম্মদ ওমর হামজা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করার জন্য প্রেরণ করেছেন। দরূদ ও সালাম প্রিয়নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যিনি স্বীয় উম্মতকে সময়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার দিক নিদর্শনা দিয়েছেন এবং শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কেরামের উপর যাঁরা ছিলেন মহানবী (সাঃ) এর সুন্নাহকে একনিষ্ঠভাবে ধারণকারী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়,তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। অতঃপর…….

সম্মানিত  ভাইগণ,
আল্লাহ তা’আলার অশেষ রাহমতের উপর ভরসা করে আমি আজকের জুমুআর খুতবায় মানব জীবন ঘনিষ্ট ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ‘সময় ব্যবস্থাপনার ‘ উপর যথাসম্ভব সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছা করছি। (তবে আমাদের কোন জ্ঞান নেই তুমি (আল্লাহ) যা শিখিয়েছো তা ছাড়া)। আলোচ্য বিষয়ের সূক্ষ্ম-বিচার বিশ্লেষণ করা আমাদের মত অতি স্বল্প বোধ বিবেচকের পক্ষে কতটুকু সম্ভব তা অনিশ্চিত। তবে বিষয়টির প্রতি সর্ব মহলের সচেতন দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্ত এ প্রয়াস। আসলে ‘সময় ব্যবস্থাপনা ‘ বা Time management. সকল শ্রেণীর কর্মজীবী,শ্রমজীবী, পেশাজীবী বা চাকুরীজীবি এমনকি সকল স্তর ও পর্যায়ের গণমানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আমাদের ধারণায় ” মানুষ প্রতিদিনের ও প্রতিমুহূর্তের স্বীয় কার্যক্রমকে সময়সুচি বা ছক মোতাবেক শৃংখলিত করার নামই হল সময় ব্যবস্থাপনা। ” ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম স্তম্ভ সালাত সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ : ” সালাত তো মু’মিনদের উপর সময় নির্ধারিত একটি ফরয।” এ ছাড়া ও আমাদের আল্লাহমূখী শরীয়ত আমাদের জন্য সালাত ব্যতীত বহু বিধানের ক্ষেত্রে ও সময়ের বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে : যেমন – হজ্ব, যাকাত, সাওম, সদকায়ে ফিতর, কোরবানী, সফর, তায়াম্মুম, স্তন্যদান, তালাক প্রদান, ইদ্দত পালন, তালাক প্রত্যাহার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ও শরীয়ত সময়কে সম্পৃক্ত করেছে।এর দ্বারা সময়ানুবর্তিতার প্রতি মুমিনদেরকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে।

সম্মানিত মু’মিন -মুসলিম ভাইগণ,
মিসরীয় প্রখ্যাত চিন্তাবিদ উস্তায হাসানুল বান্না (রহ) বলেন,’ সময়ই জীবন ‘। তার মানে – মানব জীবনের সবচেয়ে দামী সম্পদ হলো “সময়”। সময় স্বর্ণের চেয়ে ও দামী ও হীরার চেয়েও মূল্যবান। মানব জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি সময়ের সঠিক ব্যবহার ও বিন্যাসের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তা’আলা সময়ের গুরুত্বারোপ করে কুর’আন শরীফের সূরা নাহলের ৬১ নম্বর আয়াতে বলেন : ” অতঃপর যখন তাদের সময় আসে তখন তারা মুহূর্ত কাল আগ অথবা পিছ করতে পারে না। ” আসলে মানব জীবনে অন্যতম মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত হলো ” সময়”। সময় হল মানব অস্তিত্বের ক্ষেত্র ও জীবনের মূলধন। পবিত্র কুর’আনে এই মৌলিক নিয়ামতের বিরাটত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছে এবং অন্যান্য নিয়ামতের উপর তার শ্রেষ্ঠত্বর প্রতি ও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফলে আল কুর’আনের বহু সংখ্যক আয়াত এসেছে সময়ের মূল্য এবং তার সমুন্নত মর্যাদা ও বিরাট প্রভাবের প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে। এ রকম কিছু আয়াত, যেমন (ক) সূরা ইবরাহীমের ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ” তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে, যারা অবিরাম একই নিয়মের অনুবর্তী এবং তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে। ” এভাবে আল্লাহ তা’আলা এই মহা অনুগ্রহ ‘ সময় সম্পদের ‘ মূল্য বুঝাতে গিয়ে বহু আয়াতে এর উল্লেখ করেছেন। (খ) সূরা নাহলের ১২নম্বর আয়াতে বলেন : ” তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত, দিন, সূর্য এবং চন্দ্রকে আর নক্ষত্ররাজি ও অধিন হয়েছে তাঁরই নির্দেশে। অবশ্যই এতে বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিশ্চিত নিদর্শন। ” (গ )সূরা বনী ইসরাঈলের ১২ নম্বর আয়াতাংশে রাত ও দিনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন: ” এবং যাতে তোমরা বর্ষ – সংখ্যা ও হিসাব জানতে পার, আর আমি সবকিছু বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। ” এ ছাড়া ও সময় এর মত বিরাট এই নিয়ামত সম্পর্কে আরও বহু আয়াত রয়েছে। এমনকি আল্লাহ তা’আলা সময়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝাতে গিয়ে বহু সংখ্যক আয়াতে সময়ের বিভিন্ন স্তরের শপথ করেছেন। রাত, দিন, পূর্বাহ্ন, অপরাহ্ন, প্রভাত ও গোধুলীকালের শপথ কুর’আনের বিভিন্ন জায়গায় এসেছে। যথা – সূরা লাইলের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে ” শপথ রাতের, যা তা আচ্ছন্ন করে । শপথ দিনের যখন তা উদ্ভাসিত হয়। ” সূরা মুদ্দাছ্ছিরের ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আয়াতে : “শপথ রাতের যখন তার অবসান হয়। শপথ দিনের যখন তা আলোকোজ্জ্বল হয়। ” সূরা ইনশিকাকের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতে ” আমি শপথ করি অন্তরাগের ও রাতের এবং তাতে যার সমাবেশ ঘটে তার। ” সরা ফাজরের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে “শপথ ঊষার। শপথ দশ রাতের। সূরা দুহার ১ ও ২ নম্বর আয়াতে ” শপথ পূর্বাহ্নের। শপথ রাতের, যখন তা হয় নিঝুম। ” সর্বোপরি আল্লাহ তা’আলা সূরা আসরের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে ” মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত। ” প্রখ্যাত মুফাসসীর ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থে সূরা আসর এর. ব্যাখ্যায় লিখেছেন তার সংক্ষেপ এই – ” আল্লাহ তা’আলা সময়ের শপথ করেছেন, কারণ সময়ের মাঝেই আবর্তিত হয় ও অস্তিত্ব লাভ করে সকল বিস্ময়কর বিষয়। কেননা দূনিয়ার সবকিছু ও সকল বিষয় এই সময়ের পরিধিতেই পরিবেষ্টিত। মানুষের সূখ-সাচ্ছন্দ্য, দূঃখ-দুর্দশা, সুস্থতা-অসুস্থতা, ধন-ঐশ্বর্য ও অভাব-দারিদ্র সবকিছুর প্রকাশ তো সময়ের মাঝেই হয়। তাই পৃথিবীর কোন কিছুই সময়ের মত মূল্যবান নয়। “

মান্যবর  ভাইগণ,
আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর অমিয় বাণী হাদীস শরীফে ‘ সময়ের ‘ প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। ইমাম আহমদ (রহ) বিশিষ্ট সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, পাঁচটি বিষয়কে পাঁচ বিষয়ের পূর্বেই গনিমত ( অমূল্য রত্ন) মনে কর – ১. তোমার যৌবন কালকে বার্ধক্য আসার পূর্বে। ২. তোমার সুস্থতাকে অসুস্থ হওয়ার পূর্বে। ৩. তোমার অবসর কালকে ব্যস্ততায় লিপ্ত হওয়ার পূর্বে। ৪. তোমার আর্থিক সচ্ছলতাকে দারিদ্রতার পূর্বেই এবং ৫. তোমার হায়াতকে মৃত্যুর পূর্বেই।” ইমাম তিরমিযি (রহ) সাহাবী ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানগণ পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত না হয়ে এক কদম ও সামনে অগ্রসর হতে পারবেনা – ১.তার হায়াত সম্পর্কে কি কাজে তাকে বিনষ্ট করেছে । ২. তার যৌবন সম্পর্কে কিভাবে তা ব্যবহার করেছে। ৩. তার সম্পদ সম্পর্কে কিভাবে তা উপার্যন করেছে এবং ৪. কোথায় তা ব্যয় করেছে। আর ৫. সে যে বিদ্যার্জন করেছে সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। অপর রেওয়ায়তে চারটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে । এমনকি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বহু হাদীসে তাঁর উম্মতকে বারবার সতর্ক করেছেন সময়ের সদ্ব্যবহারের এবং তা থেকে যথাযথভাবে উপকৃত হওয়ার পন্থা নিয়ে। যেমন ইঙ্গিতার্থে এক হাদীসে বলেন,” মু’মিন দুই শঙ্কা কালের মাঝে থাকে। একটি কাল হল যা অতিবাহিত হয়েছে ( তথা, বিগতকাল) কিন্তু সে জানে না – সে ব্যাপারে আল্লাহ কী করবেন, অন্যটি হল ভবিষ্যৎকাল আর সে জানে না আল্লাহ তাতে কী ফায়সালা করবেন।” আমাদের আলোচনার মূলকথা হলো পৃথিবীর কোন কিছুই সময়ের মত মূল্যবান নয়। প্রবাদ আছে যে, ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের চেয়ে ও ফলদায়ক।’ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ প্রবাদ বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য – কারণ,সফলতা শুধু সূক্ষ্ম পরিকল্পনা ও অনুকূল পরিস্থতির মাধ্যমেই আসে না। বরং তা সময় ব্যবস্থাপনা তথা সময়ানুবর্তিতার উপরই নির্ভর করে। প্রত্যেকের উচিৎ নিজের থেকে স্ব স্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাসময় সম্পাদন করে আখিরাতের ফসলের জন্য দূনিয়ার শস্যক্ষেত্রে নিষ্ঠার সাথে শ্রম দিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ সময়ের মূল্যায়ন করা এবং নিজে নিজেই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পূর্বে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে তৌফিক দিন। বস্তুত , আল্লাহ তা’আলা সূরা ইউনুস এর ৪৯ নম্বর আয়াতাংশে বলেন : “প্রত্যেক জাতির এক নির্দিষ্ট সময় আছে ; যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহূর্তকাল ও বিলম্ব বা ত্বরা করতে পারবে না “।

লেখক: অধ্যক্ষ (অবসর প্রাপ্ত) খুটাখালী তমিজিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা।
২৭/১২/২০২৪ খ্রিঃ মোতাবেক ২৬/০৬/১৪৪৬ হিঃ
জুমুআ বার।